মনোয়ার জাহান চৌধুরী, অতিথি প্রতিবেদক :: সিলেটে থামছে না উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিপাত। যে কারণে সিলেটে বন্যার পানি বাড়ছেই। সেই সাথে ডুবছে জনপদ। আর বন্যা থাকায় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের পাথর কোয়ারিতে নিয়োজিত প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এছাড়া পাথর কোয়ারিতে শ্রমিক নামতেও নিষেধ দিয়েছে দু’টি উপজেলা প্রশাসন। এমনকি এই বন্যায় পিকনিক স্পটেও পর্যটকদের না যেতে বলা হয়েছে।
- বন্যায় বেকার সিলেটের আড়াই লাখ শ্রমিক
- ১৪৯ বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ
- পাথর কোয়ারিতে শ্রমিক না নামার নির্দেশ
এদিকে টানা বর্ষণে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রয়েছে পাঠদান। বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলার কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৪৯টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৯৯টি ও কোম্পানীগঞ্জে ৪০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। দুই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার পাল বলেন, পাহাড়ি ঢল আর বন্যার কারণে জেলা সদরের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। উপজেলার ৯৯টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ আছে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা চলাকালীন সময়ে কোনো শ্রমিককে পাথর কোয়ারিতে না নামার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, শনিবার সিলেটের জেলা প্রশাসক জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের বেশ কয়েকটি বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে অব্যাহত বৃষ্টি থামায় শনিবারও নতুন করে জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ও ধলাই এবং গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি ও জাফলং পাথর কোয়ারির সকল প্রকার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। যার কারণে এসব পাথর কোয়ারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এছাড়া বন্যার কারণে পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। জেলা সদরের সাথে কানাইঘাট উপজেলাসহ জেলা ও উপজেলা শহরের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এমনকি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটের দেড় শত বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী জানান, ‘বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। বন্যার্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেছি। অব্যাহত বর্ষণে উপজেলার ৪০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বন্যায় পানি বাড়ার কারণে উপজেলা সদরের সঙ্গে নিম্নাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বন্যা মোকাবেলায় উপজেলার সকল দফতর সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে এবং একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, পাথর কোয়ারিতে কোনো শ্রমিক যাতে না নামে সে জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষেধ দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পিকনিক স্পট সাদা পাথর এলাকায়ও পর্যটকদের না যেতে নিষেধ দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে বৃষ্টিতে যখন নাকাল অবস্থা তখন সিলেট আবহাওয়া অফিস বলছে, আগামী ১৭ তারিখ পর্যন্ত সিলেটে টানা বৃষ্টি হবে। এরপর থেকে বৃষ্টি ও রোদ সমানভাবে থাকবে। এই কয়েকদিনে উজানেও টানা বৃষ্টি হবে। এতে করে সিলেটে চলমান বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
সিলেটের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশের মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে, সেটা তেমন কিছু নয়, সমস্যা উজানের বৃষ্টিপাতে। ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর এলাকায় প্রতিনিয়ত ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেইসঙ্গে আমাদের দেশেও গড়ে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। উজানের ঢল নেমে একের পর এক নদ নদীর পানি বাড়ছে, নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, জুলাই মাসেই ৩৪৩ মিলিমিটার হয়েছে। এর আগে জুনে ৮০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার (১২ জুলাই) সকাল ৬ টা থেকে পরদিন শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১১৪ মিলিমিটার এবং এবং শনিবার সকাল ৬ টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
তবে যে কোন পরিস্থিতির জন্য সিলেট জেলা প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আসলাম উদ্দিন। তিনি বলেন, বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সরিয়ে আনতে এরইমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য মাইকিং করা হলেও লোকজন মালামাল রেখে বাড়ি ছেড়ে আসছেন না। আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছি। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হবে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডে সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাত ৯ টা পর্যন্ত সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪২ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা অমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমার ৬২ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর মৌলভীবাজারের শেরপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়া কানাইঘাটের লোভাছড়ায় বিপদসীমার ১৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর জৈন্তাপুর সারি নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীর বর্তমান পানির গতি প্রবাহ ১১ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সকল নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। আশা করা হচ্ছে পানি নেমে যাবে। নদীভাঙন ও বন্যা এড়াতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।
সুত্র : সময়ের আলো
সিলেট৭১নিউজ/এআ